চলছে সিয়াম সাধনার মাস। মুসলমানদের অতি পবিত্রতার মাস। রমজান মাসের ৩০ দিনের প্রতিদিনই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে সিয়াম সাধনা করার নিয়ম রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা তা পালন করে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নিশীথ সূর্যের দেশ হিসেবে খ্যাত বা পৃথিবীর উত্তর মেরুর যেসব দেশে গ্রীষ্মকালে কখনোই সূর্য ডোবে না সেখানকার মুসলমানরা কীভাবে রোজা রাখেন? রমজান মাস যেহেতু চন্দ্রপঞ্জিকার ওপর নির্ভর করে চলে তাই কয়েক বছর পরপরই ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে রোজা শুরু হয়। এ বছরের মতো বিদায়ী গ্রীষ্মে সর্বশেষ রোজা শুরু হয়েছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তবে সেসময় এমন প্রশ্নের সম্মুখিন কাউকে হতে হয়নি। কারণ ওই সময় উত্তর মেরুর দেশগুলোতে মুসলমানদের খুব একটা বসবাস ছিল না। নব্বই দশকের শুরু থেকেই সোমালিয়া, ইরাক, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের মতো উত্তর মেরুর দেশগুলোতে অভিবাসী হতে থাকে। এ দেশগুলোতে বছরের প্রায় ছয় মাস কখনোই সূর্য অস্ত যায় না। এর ফলে দেশগুলোতে বর্তমানে অবস্থানরত মুসলিমদের রোজা পালন নিয়ে একটি নির্মম বাস্তবতা ও নৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ওখানকার মুসলমানরা তাহলে কীভাবে রোজা রাখছেন? সম্প্রতি এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার এক সাংবাদিক নরওয়ের সর্ব উত্তরের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ট্রোমসো যান। ওখানকার মুসলমানদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তিনি জানতে পারেন কীভাবে তারা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে সিয়াম সাধনা করছেন। ট্রোমসো শহরটি ভৌগলিকভাবে আর্কটিক সার্কেল বা সুমেরু বৃত্তের প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। শহরের চারদিক বরাফাবৃত পর্বতমালা ও সমুদ্রের খাঁড়ি দিয়ে ঘেরা। প্রতি বছর মে মাসের শেষদিক থেকে শুরু করে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত শহরটির বাসিন্দারা ‘মিডনাইট সান’ বা ‘মধ্যরাতে সুর্য’ দেখার এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সময়ের হিসেব কষে ঠিক এ বছরই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রোমসোর মুসলিম সম্প্রদায় পুরো রমজানে রাতের দেখা পাবেন না। তাহলে কীভাবে তারা রোজা রাখছেন? ১৯৮৬ সালেও এই একই সময়ে রোজা এসেছিল। কিন্তু সেসময় ট্রোমসো শহরে কোনো মুসলিমের বসবাস ছিল না বলে প্রশ্নটি সামনে আসেনি। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমদের আগমনে বর্তমানে ট্রোমসো মুসলমানদের শহরে পরিণত হয়েছে। সেখানকার অধিবাসীরা জানিয়েছেন, সুর্য এখানে কখনোই ডোবে না। ২৪ ঘন্টাই আকাশের মাঝখানে অবস্থান করে। তাই এ শহরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হিসেব করে রোজা রাখা কখনোই সম্ভব নয়। এখানকার মুসলমানরা নিকটবর্তী এমন কোনো দেশের সঙ্গে সময় মিলিয়ে রোজা রাখেন যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়। আবার সৌদি আরবের মক্কা নগরীর সময়ের সঙ্গে মিল রেখে দিনের হিসাব করেও রোজা রাখার নিয়ম রয়েছে। তবে সেটা তারা সম্মিলিতভাবে আলোচনা করে নির্ধারন করেন। এ বছর সৌদি আরবের মক্কার সময়ের সঙ্গে মিল রেখেই তারা রোজা পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মক্কায় যদি ভোর পাঁচটায় সূর্যোদয় হয় তাহলে ট্রোমসোর মুসলিমরাও নরওয়ের স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটা থেকেই দিনের সময় গণনা শুরু করবেন। মক্কার দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য খুবই ভারসাম্যপূর্ণ বলেই তারা এ নিয়মটি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুধু রোজা নয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়ও তারা এভাবেই বিন্যস্ত করে পালন করছেন। এ তো গেল দিনের কথা। ট্রোমসোর মুসলমানদের এর আগেও অনেকবার রোজা রাখার জন্যে সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। শীতকালে তাদেরকে এর ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ শীতকালে এখানে সারাক্ষণই রাত থাকে। সূর্যের দেখা মেলে না প্রায় ছয় মাস। তাই শীতকালের জন্যেও তারা মক্কার নিয়মই অনুসরণ করেন। গ্রীষ্মকালে যেমন সূর্য অস্ত যায় না তেমনি শীতকালে সূর্যোদয় হয় না। তাই মক্কার সময় অনুসরণ করাটাই তারা শ্রেয় মনে করেন।
পৃথিবী দুই মেরুতে বিভক্ত। দুই মেরুতে দিন ও রাতের হিসেব একেবারেই আলাদা। দুই মেরুতেই দিন অথবা রাত খুব দীর্ঘ হয়। এমনও দেখা যায়, টানা ছয় মাস ঝলমলে দিন। ২৪ ঘণ্টা সূর্য এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে ছুটে যায়। কিন্তু অস্ত যাবার কোনো তাড়া নেই তার। আবার ছয় মাস অতল গহ্বরে ডুব। ছয় মাস রাত।
ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক (গ্রিনল্যন্ড), রাশিয়া, আইসল্যান্ড, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার কিছু অংশে গ্রীষ্মকালের একটি বড় সময় সূর্য কখনোই অস্ত যায় না। এটাকে নিশীথ সূর্য নামে অভিহিত করা হয়। কুমেরু বৃত্তের দক্ষিণ মেরুতে কোনো স্থায়ী বসতি না থাকায় সুমেরু বৃত্তের উত্তরাঞ্চলের মানুষরা সীমিত আকারে এ ঘটনার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ফিনল্যান্ডের একেবারে উত্তর প্রান্তে ৭০ দিনেরও বেশি সময় ধরে সূর্য ডোবে না। অপর দিকে ইউরোপের সর্ব উত্তর প্রান্ত নরওয়ের স্বালবার্ড অঞ্চলে ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত চার মাসের বেশি সময় সূর্যাস্ত হয় না। কোনো কোনো জায়গায়